খ. মূত্র সৃষ্টি (Formation of Urine):
স্কটিশ শারীরবিজ্ঞানী Arthur Robertson Cushney (1917)-র মতে, নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে আসার পর তিনটি ধাপে মূত্র সৃষ্টি হয়, যথা: (১) অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ, (২) টিউবিউলার পুনঃশোষণ এবং (৩) সক্রিয় ক্ষরণ ।
১. অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ বা আল্ট্রাফিল্ট্রেশন (Ultrafiltration)
মূত্র তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে রক্তের অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ। নেফ্রনের রেনাল করপাসলে এ পদ্ধতি সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ড থেকে পৃষ্ঠীয় ধমনি, রেনাল ধমনি এবং অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের মাধ্যমে রক্ত অতি উচ্চ চাপে গ্লোমেরুলাসে প্রবেশ করে। সাধারণত অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের তুলনায় ইফারেন্ট আর্টারিওলের ব্যাস সংকীর্ণ হওয়ায় গ্লোমেরুলাসে রক্তের উচ্চ চাপ সৃষ্টি হয়। এ হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপে রক্তের প্রোটিন ও রক্তকণিকা ছাড়া সমস্ত পানি, লবণ, শর্করা, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড প্রভৃতি কৈশিক জালিকার এন্ডোথেলিয়াম ও ভিত্তিঝিল্লি এবং রেনাল ক্যাপসুলের এপিথেলিয়াম ভেদ করে ক্যাপসুলার স্পেস-এ জমা হয়। এ পরিস্রুত তরলকে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বা প্রাথমিক মূত্র বলে। মানবদেহের দুটি বৃক্কের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে প্রায় 1200 ml রক্ত প্রবাহিত হয়। এর রক্ত থেকে প্রায় 125 ml গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বৃক্কের মাধ্যমে বোম্যানস ক্যাপসুল-এ জমা হয়।
অন্যদিকে পরিস্রুত রক্ত পরে ইফারেন্ট আর্টারিওলে প্রবেশ করে। যে চাপের মাধ্যমে রক্তের দ্রাব্য বস্তু পরিস্রুত হয়, তাকে বলে কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ (effective filtration pressure)। পরিস্রাবণ প্রক্রিয়াটি চাপ প্রয়োগের ফলে সংঘটিত হয় বলে একে আল্ট্রাফিল্ট্রেশন বলা হয় । হিসেবে দেখা গেছে, কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ ২৫ mmHg। এ চাপের প্রভাবে প্রতি মিনিটে প্রায় ১২৫ ml রক্তরস গ্লোমেরুলাস থেকে পরিস্রুত হয়। তবে এ হার পরিস্রাবণ চাপের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
২. টিউবিউলার পুনঃশোষণ বা নির্বাচিত পুনঃশোষণ (Tubular reabsorption or Selective reabsorption) :
বোম্যানস ক্যাপসুল থেকে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট বৃক্ক নালিকা বা রেনাল টিউবিউলে প্রবেশ করে। এখানে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট ৮০% নির্বাচিত পদার্থ পুনঃশোষিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে। টিউবিউলের প্রাচীরের কোষগুলো পুনঃশোষণের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। যেমন- কোষগুলোর একপাশে মাইক্রোভিলাই ও বেসাল চ্যানেল থাকায় এদের শোষণতল বেশি সাইটোপ্লাজমে বেশি সংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। রক্তের কৈশিক জালিকার সাথে ঘন সন্নিবিষ্ট থাকে। রেনাল টিউবিউলসের বিভিন্ন অংশে যেসব পদার্থের পুনঃশোষণ হয় তা হলো –
প্রক্সিমাল বা নিকটবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Proximal convoluted tubule) : এখানে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের ৬০% পুনঃশোষিত হয়। গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড, ভিটামিন, হরমোন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ফসফেট, বাইকার্বোনেট, পানি, কিছু ইউরিয়া ইত্যাদি এ অংশে পুনঃশোষিত হয়।
নেফ্রন এ মূত্র সৃষ্টি কৌশলঃ
হেনরির লুপ (Loop of Henle) : এখানে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি পুনঃশোষিত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
ডিস্টাল বা দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Distal convoluted tubule) : এখানে পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি যত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
সংগ্রাহী নালি (Collecting Duct) : এখানে প্রধানত পানি এবং অল্প Cl–, Na+ ও ইউরিয়া পুনঃশোষিত হয়।
৩. টিউবিউলার ক্ষরণ বা সক্রিয় ক্ষরণ (Tubular or Active secretion) :
বিপাক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কিছু অপ্রয়োজনীয় উপজাত পদার্থ, যথা- ক্রিয়েটিনিন ও কিছু ইউরিয়া প্রক্সিমাল প্যাঁচানো নালিকার চারপাশে রক্তজালক থেকে সক্রিয় ক্ষরণের মাধ্যমে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের সাথে যুক্ত হয়। ডিস্টাল প্যাঁচানো নালিকায় হাইড্রোজেন আয়ন, পটাসিয়াম ও অ্যামোনিয়াম আয়ন, সেরেটোনিন, কোলিন, হিস্টামিন ইত্যাদি ক্ষরিত হয়ে ফিলট্রেটের সাথে মিশে মূত্রে (urine) পরিণত হয়। উৎপন্ন মূত্র অতঃপর সংগ্রাহী নালিকা, ইউরেটার হয়ে মূত্রথলি থেকে মূত্রনালির মাধ্যমে বাইরে নিষ্কাশিত হয়।
মূত্র বা নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের গতিপথ নিচে দেখানো হলো :
হৃৎপিণ্ড → অ্যাওর্টা → পৃষ্ঠীয় মহাধমনি → রেনাল ধমনি → অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল → গ্লোমেরুলাস → বোম্যানস ক্যাপসুলের গহ্বর → রেনাল টিউবিউলস → সংগ্রাহী নালি → বৃক্কের পেলভিস → ইউরেটার → মূত্রথলি → মূত্রনালি → রেচন ছিদ্র → দেহের বাইরে নিষ্কাশন।
মূত্র (Urine):
নেফ্রনের রেনাল টিউবিউলসে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেটের নির্বাচিত পুনঃশোষণের পর যে খড় বর্ণের, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত ও অম্লধর্মী তরল রেচন(Excretion) বর্জ্য মূত্রথলিতে জমা হয় তাকে মূত্র বলে। একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ১.৫ লিটার মূত্রের মূত্র ত্যাগ করে। তবে কিছু কারণে এ পরিমাণ প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন- খাদ্যে তরল পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলে মূত্রের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও শরীরে ঘাম বেশি হলে মূত্রের পরিমাণ কমে যায়। খাদ্যের প্রকৃতিও অনেক সময় মূত্রের পরিমাণের পার্থক্য ঘটায়। লবণাক্ত খাদ্য সাধারণত মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়। বহুমূত্র (diabetes), বৃক্ক প্রদাহ (nephritis) প্রভৃতি রোগ প্রস্রাবের হার ও মাত্রা উভয়কে প্রভাবিত করে। কিছু দ্রব্য মূত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাড়িয়ে দেয়। এসব দ্রব্য ডাইইউরেটিকস (diuretics) বা মূত্রবর্ধক নামে পরিচিত । পানি, লবণাক্ত পানি, চা ও কফি এ ধরনের দ্রব্য।
মূত্রের বৈশিষ্ট্য (Properties of Urine) :
পরিমাণ : প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের বৃক্কে দৈনিক ০.৫ থেকে ২.৫ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়।
বর্ণ : মূত্রে ইউরোক্রোম নামক রঞ্জক পদার্থ থাকায় এটি খড় (হালকা হলুদ) বর্ণের হয়।
গন্ধ : মূত্রের গন্ধ অনেকটা ঝাঁঝালো। দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ ইউরিনোড (C6H8O)- এর উপস্থিতির জন্য মূত্রে এরূপ গন্ধ হয়।
রাসায়নিক ধর্ম : মূত্র সামান্য অম্লীয়। এর pH মান ৫.০ – ৬.৫।
আপেক্ষিক গুরুত্ব : মূত্রের স্বাভাবিক আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০৮ – ১.০৩০।
মূত্রের উপাদান (Urine components) :
মূত্রের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে ৯৫% (৯৫-৯৭%) পানি এবং ৫% এর মধ্যে জৈব ও অজৈব উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে সামান্য পরিমাণে আয়োডিন, সিসা, আর্সেকনিক প্রভৃতি পাওয়া যায়।
মূত্রে যেসব উপাদান পাওয়া যায় সেগুলো হলোঃ
উপাদান | শতকরা হার |
---|---|
পানি | ৯৫ |
ইউরিয়া | ২ |
ইউরিক এসিড | ০.০৫ |
ক্রিয়েটিনিন | ০.০৭৫ |
সোডিয়াম | ০.৩৫ |
অ্যামোনিয়াম | ০.০৪ |
পটাসিয়াম | ০.১৫ |
ম্যাগনেসিয়াম | ০.০১ |
ক্লোরাইড | ০.৬০ |
সালফেট | ০.১৮ |
ফসফেট | ০.২৭ |
অন্যান্য | ১.২৭৫ |
ইউরিক এসিড
ক্রিয়েটিনিন
গ্লুকোজ
ইউরিয়া
সবগুলো
আরও দেখুন...